জোয়ার ভাটা কেন হয়? জোয়ার ভাটা কি?
জোয়ার ভাটা কি? কেন জোয়ার ভাটা হয় ? বাংলাদেশ আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি।এই দেশ নদীমাতৃক দেশ। বাংলাদেশে ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় ৪০৫ টির মত নদী রয়েছে৷
আমরা একটু খেয়াল করলে দেখবো যে, সাধারনত এক এলাকার নদীর পানি হঠাৎ বেড়ে গেছে তো অন্য এলাকার নদীর পানি হঠাৎ কমতে শুরু করেছে৷ মূলত, আমাদের পৃথিবীর উপর চন্দ্র ও সূর্যের আকর্ষণের কারণে নদী ও সমুদ্রের পানি হঠাৎ ফুলে উঠে আবার হঠাৎ নামতে শুরু করে।
আমরা আলোচনায় জানব- জোয়ার ভাটা কি? কেন জোয়ার ভাটা হয় ?
জোয়ার ভাটা কি || জোয়ার–ভাটা কেন হয় || জোয়ার ভাটার কারণ || দিনে কতবার জোয়ার–ভাটা হয়|| জোয়ার–ভাটার সময় কেন পরিবর্তন হয়|| জোয়ার–ভাটার সুবিধা অসুবিধা
প্রধানত চাঁদের আকর্ষণের ফলে নদী বা সমুদ্রের পানি ফুলে ওঠাকে জোয়ার বলা হয়। আবার দেখা যায়, জোয়ারের সময় নদী বা সমুদ্রের পানি যে জায়গায় ফুলে যাচ্ছে ঠিক তার সমকোণে অবস্থিত স্থান থেকে পানি নামতে শুরু করেছে৷ চাঁদের সমকোণ স্থানে পানি নেমে যাওয়াকে বলা হয় ভাটা৷ আরও সহজ ভাবে বলা যায় যে,চন্দ্র ও সূর্যের আকর্ষণে প্রতিদিন নিয়মিতভাবে সমুদ্রের পানি একই স্থানে ছন্দময় উত্থানকে জোয়ার ও পতনকে ভাটা বলে।
সমুদ্রের কোনো এক জায়গায় প্রতিদিন সাধারণত দুইবার করে জোয়ার-ভাঁটা সংঘটিত হতে পারে। এবং উপকূলে কোনো একটি স্থানে পর পর দুটি জোয়ার বা পর পর দুটি ভাটার মধ্যে ব্যবধান হলো ১২ ঘণ্টা।
জোয়ার ভাটার কারণ কয়টি / জোয়ার ভাটা কেন হয়?
জোয়ার ভাটার কারণ বা জোয়ার ভাটার সংঘটনের প্রধান কারণঃ
জোয়ার-ভাটা প্রধানত দুটি কারণে সৃষ্টি হয়ে থাকে। কারণসমূহ নিম্নে উল্লেখ করা হল:
১। পৃথিবীর আবর্তন
২। পৃথিবীর উপর সূর্য ও চাঁদের আকর্ষণ।
পৃথিবীর আবর্তন কি?
আমরা সবাই জানি যে, পৃথিবী সূর্যকে কেন্দ্র করে তার নিজ অক্ষ পথে একটি নির্দিষ্ট গতিতে অবিরাম ঘুরে চলেছে। পৃথিবীর এই আবর্তন গতির ফলে এক ধরনের শক্তি উৎপন্ন হয় যা কিনা কেন্দ্রবিমুখী ও কেন্দ্র বহির্মুখী শক্তি হিসেবে পরিচিত।
কেন্দ্র বর্হিমুখী শক্তি সমুদ্রের জলকে প্রভাবিত করলে এই বহির্মুখী শক্তির প্রভাবে সমুদ্রের পানি বাইরের দিকে বেরিয়ে যেতে চায়। চাঁদের আকর্ষণের কারণে সমুদ্রের যেখানে জোয়ার সৃষ্টি হয় তার ঠিক বিপরীত দিকে চাঁদের আকর্ষণ এর তুলনায় কেন্দ্রবিমুখ বলের প্রভাব বেশি হয় ফলে সমুদ্রের ওই স্থানেও জোয়ার সৃষ্টি হয়।
আর সমুদ্রের পরস্পর বিপরীত যে দুটি স্থানে জোয়ার হয় তার সমকোণে অবস্থিত দুটি স্থানে পানি নেমে গিয়ে তখন ভাটা হয়।
পৃথিবীর উপর চাঁদ ও সূর্যের আকর্ষণ :
জোয়ার-ভাঁটা সৃষ্টিতে সূর্যের আকর্ষণ অপেক্ষা চাঁদের আকর্ষণ বেশী কার্যকর কেনো?
আমাদের চাঁদের তুলনায় সূর্য পৃথিবী থেকে প্রায় ৩৯০ গুন বেশি দূরে অবস্থিত এবং সূর্যের ভর চাঁদের তুলনায় প্রায় ২ কোটি ৬০ লক্ষ গুণ বেশি।কিন্তু চাঁদের ভর কম হলেও সূর্যের তুলনায় চাঁদ আমাদের পৃথিবীর অনেক কাছে অবস্থান করে৷ আর এই কম দূরত্ব হবার কারণে পৃথিবীর উপর চাঁদের আকর্ষণ সূর্যের তুলনায় প্রায় দুই গুণ বেশি। তাই জোয়ার-ভাটা সৃষ্টিতে সূর্যের তুলনার চাঁদের ভূমিকা বেশি। চাঁদের এই আকর্ষণই জোয়ারের সৃষ্টি করে৷
জোয়ার ভাটার সময়ের ব্যবধান:
আমরা জানি পৃথিবীর গতি দুই ধরণের হয়।
১। আহ্নিক গতি
২। বার্ষিক গতি।
বার্ষিক গতির কারণে পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘুরে, ঠিক তেমনি আহ্নিক গতির কারণে নিজ মেরুরেখায় একটি নির্দিষ্ট গতিতে একবার ঘুরতে ২৩ ঘন্টা ৫৬ মিনিট ৪ সেকেন্ড সময় নেয়। এর ফলে দিন-রাত হয়। আহ্নিক গতির ফলে পৃথিবীর প্রত্যেকটি দ্রাঘিমা একবার করে চাঁদের সরাসরি সামনে আসে। এরফলে ২৪ ঘন্টায় একই জায়গায় ২ বার জোয়ার এবং ২ বার ভাটা হয়।
জোয়ার প্রধানত দুই প্রকার
১। মুখ্য জোয়ার:
চাঁদ যখন পৃথিবীর চারদিকে আবর্তন করে তখন পৃথিবীর যে অংশ চাঁদের নিকটবর্তী বা মুখোমুখি অবস্হান থাকে, সেই অংশে চাঁদের আকর্ষণের প্রভাবে পানি ফুলে উঠে তথা জোয়ারের সৃষ্টি হয়। এরূপ জোয়ারকে মুখ্য জোয়ার বলে। কোনো স্থানে একবার মুখ্য জোয়ার হওয়ার পর প্রায় ২৪ ঘণ্টা ৫২ মিনিট সময় অতিক্রম করলে পুনরায় সেখানে মুখ্য জোয়ার সৃষ্টি হয়ে থাকে।
২। গৌণ জোয়ার:
গৌণ জোয়ার এর মূল কারন? সহজ ভাবে বলতে গেলে মুখ্য জোয়ার পৃথিবীর যে অংশে সংগঠিত হয় তার ঠিক বিপরীত পাশে গৌণ জোয়ার চলে।
চাঁদ পৃথিবীর যে পাশে আকর্ষণ করে তার ঠিক বিপরীত পাশে পানির ওপর মহাকর্ষ বল অনেকাংশে কমে যায়,এর ফলে সে স্থানে কেন্দ্রাতিগ শক্তির সৃষ্টি হয়। এর ফলে চারদিকের পানি ঐ স্থানে এসে জোয়ারের সৃষ্টি করে। এরূপ সৃষ্ট জোয়ারকে গৌণ জোয়ার বলে।
ভরা কটাল বা তেজ কটালঃ
জোয়ার ভাটার ভরা কটাল কখন হয়? অমাবস্যা ও পূর্ণিমা তিথি সময় পৃথিবী, চাঁদ ও সূর্য একই সরল রেখায় অবস্থান করে থাকে। এতে চাঁদ ও সূর্যের মিলিত বলের প্রবল আকর্ষণ সৃষ্টি হয়,সেই আকর্ষণে ফলে পৃথিবীতে যে তীব্র জোয়ারের সৃষ্টি হয়, তাকে তেজ কটাল বা ভরা কটাল বলে।
মরা কটাল:
কৃষ্ণপক্ষ ও শুক্লপক্ষের অষ্টমী তিথিতে চাঁদ ও সূর্য পৃথিবীর সঙ্গে পরস্পর সমকোণে অবস্হান করে।এতে চাঁদের আকর্ষণে যেদিকে পানি ফুলে ওঠে ঠিক তার সমকোণে সূর্যের আকর্ষণেও সমুদ্রের পানি ফুলে ওঠে। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে চাঁদ ও সূর্যের আকর্ষণ বল পরস্পর বিপরীতে কাজ করে। তাই সমুদ্রের পানি সেভাবে ফুলে ওঠে না, এইভাবে সৃষ্ট জোয়ারকে মরা কটাল বলা হয়ে থাকে। সাধারনত প্রতি এক মাসে দুইবার তেজ কটাল এবং দুইবার মরা কটাল হয়ে থাকে।
অ্যাপোজি,পেরিজি ও সিজিগি বলতে কি বুঝি?
অ্যাপোজিঃ চাঁদ পৃথিবীকে প্রদক্ষিন করার পথে পৃথিবী ও চাঁদের মাঝে দূরত্ব যখন সবথেকে বেশি হয় তখন চাঁদের এই দূর অবস্থানকে অ্যাপোজি অপভু বলে।
পেরিজিঃ চাঁদ পৃথিবীকে প্রদক্ষিন করার পথে পৃথিবী ও চাঁদের মাঝে দূরত্ব যখন সবথেকে কম হয় তখন চাঁদের এই নিকটতম অবস্থানকে পেরিজি বলে।
সিজিগিঃ পৃথিবী,সূর্য ও চাঁদ যখন অমাবস্যায় ও পূর্নিমায় একই সরলরেখায় পরস্পর বা একে অন্যের বিপরীতে অবস্থান করে তখন তাকে সিজিগি বলে।
জোয়ার–ভাটার ফলাফল
জোয়ার ভাটার প্রভাব সবচেয়ে বেশি দেখা যায় সমুদ্র উপকূলে বা উপকূলের কাছে অবস্থিত নদ-নদী ও মানুষের জীবনে। নিম্নে জোয়ার ভাটার সুফল ও কুফল সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:
জোয়ার ভাটার সুফল:
১। উন্নত প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে জোয়ারের পানির মাধ্যমে জলবিদ্যুৎ উৎপন্ন করা যায়। বর্তমানে অনেক উন্নত দেশ জোয়ারকে কাজে লাগিয়ে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করেছে এবং সুফল ভোগ করছে।
২। নদীতে যে আবর্জনা তৈরি হয়, জোয়ারের কারণে নদীর আবর্জনা সাগরে পতিত হয়। এর ফলে নদীর পানি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকে।
৩। জোয়ারের পানি নদীর মাধ্যমে সেচের সাহায্য করে।
৪। শীত প্রধান দেশে জোয়ারের মাধ্যমে সমুদ্রের লবনাক্ত পানি নদীতে প্রবেশ করে,ফলে নদীর পানি জমে না।
৫। জোয়ার-ভাটার কারণে নদী-মোহনায় সঞ্চিত পলিমাটি সমুদ্রের দিকে চলে যায় তাতে নদী মোহনা পলিমুক্ত হয়।
৬। জোয়ার ফলে দেশের অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।জোয়ারের কারণে নদ-নদীর বিস্তার ও গভীরতা বৃদ্ধি পায় ফলে বড় বড় সমুদ্রগামী জাহাজ দেশের অভ্যন্তরে নদী-বন্দরে ঢুকতে পারে ও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটাতে সাহায্য করে।
৭। জোয়ার-ভাটায় নদীতে সামুদ্রিক মাছের আনাগােনা জেলেদের জীবনযাত্রাকে উন্নত করতে সাহায্য করে।
জোয়ার ভাটার কুফল:
১। জোয়ার ভাটার ফলে ময়লা আবর্জনার সাথে অনেক সময় পলি মাটি সাগরে পতিত না হয়ে অন্য কোন নদীতে গিয়ে পড়ে থাকে৷ ফলে এই পলিমাটি নদীর গভীরতা হ্রাস করে ফেলে।
২। প্রবল জোয়ারের হলে নদীতে যে জলস্ফীতি ঘটে তার ফলে অনেক সময় নদী তীরের চাষ-আবাদ ও বাড়ি-ঘরের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় ।
৩। জোয়ার ভাটার কারণে প্রায় সময় চাষাবাদে ব্যাঘাত ঘটে। জোয়ারের ফলে নদীর মিষ্টি পানি লবণাক্ত হয়ে যাওয়ায় তা খাওয়া ও সেচের কাজে একেবারে অনুপযুক্ত হয়ে পড়ে ।
৪। প্রবল জোয়ারের কারণে নদী তীরবর্তী গ্রামগুলো প্লাবিত হয়ে যায়। ফলে অনেক ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটে।
৫। প্রবল জোয়ারের সময় নদীতে বান আসলে তার ফলে নৌকাডুবি এবং জীবন হানির সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
জোয়ার ভাটা শক্তির ব্যবহারঃ
১। জোয়ারের লবনাক্ত পানি সংরক্ষণ করে লবণ উৎপাদন করা যায়।
২। জোয়ারের পানি সংরক্ষণ করে কৃষিকাজে ও সেচ কাজে ব্যবহার করা যায়।
৩। জোয়ার এবং ভাটার ফলে যে স্রোত তৈরি হয় তা কাজে লাগিয়ে টারবাইন ব্যবহার করে বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদন করা যায়।