ডায়াবেটিস কি? ডায়াবেটিস কত হলে নরমাল

ডায়াবেটিস কি?ডায়াবেটিস কত হলে নরমাল? ডায়াবেটিস এর অন্যান্য নাম হল বহুমূত্র রোগ, মধুমেহ বা ডায়াবেটিস মেলিটাস(ইংরেজি: Diabetes mellitus) এটি  একটি হরমোন সংশ্লিষ্ট রোগ। আমাদের দেহযন্ত্র অগ্ন্যাশয় যদি যথেষ্ট পরিমানে ইনসুলিন তৈরি করতে না পারে অথবা শরীর যদি উৎপন্ন ইনসুলিন সঠিক ভাবে ব্যবহার করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে যে রোগ হয় তা হলো ‘ডায়াবেটিস’ বা ‘বহুমূত্র রোগ’। ডায়াবেটিস হলে রক্তে চিনি বা শকর্রার উপস্থিতিজনিত অসামঞ্জস্য দেখা দেয়। ইনসুলিনের ঘাটতিই হল এ রোগের মূল কথা। আমাদের অগ্ন্যাশয় থেকে নিঃসৃত হরমোন হল ইনসুলিন, যার সহায়তায় দেহের কোষগুলো রক্ত থেকে গ্লুকোজকে নিতে সমর্থ হয় এবং একে শক্তির জন্য ব্যবহার করতে পারে। ইনসুলিন উৎপাদন বা ইনসুলিনের কাজ করার ক্ষমতা-এর যেকোনো একটি বা দুটোই যদি না হয়, তাহলে রক্তে বাড়তে থাকে গ্লুকোজ। আর এই গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণ না করা গেলে ঘটে নানা রকম জটিলতা, দেহের টিস্যু ও যন্ত্র তখন বিকল হতে থাকে।

ডায়াবেটিস কত হলে নরমাল/ ডায়াবেটিস নরমাল কত পয়েন্ট

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) মতে ডায়াবেটিস (টাইপ-১ ডায়াবেটিস ও টাইপ-২ ডায়াবেটিস উভয়ই) বলা হবে যদি রক্তে শর্করার মাত্রা একবার বাড়ে ও এর লক্ষণ প্রকাশ পায় অথবা দুইবার রক্তের শর্করা বেশি পাওয়া যায়।

খাওয়ার পর ডায়াবেটিস কত হলে নরমাল/ খালি পেটে ডায়াবেটিস কত হলে নরমাল? সাধারনত অভুক্ত অবস্থায় রক্তের গ্লুকোজ ≥ ৭.০ mmol/l (১২৬ mg/dl) অথবা গ্লুকোজ সহনশীলতা পরীক্ষায় মুখে গ্লুকোজ সেবনের দুই ঘন্টা পর রক্তের গ্লুকোজ ≥ ১১.১ mmol/l (২০০ mg/dl)।

এছাড়াও ডায়াবেটিস বলা যাবে যদি গ্লাইকেটেড হিমোগ্লোবিন (HbA1c) ≥৪৮ mmol/mol (≥৬.৫%) থাকে। 

ডায়াবেটিস এর ইতিহাস

ডায়াবেটিস কি? আজ থেকে আনুমানিক ১৫০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে প্রাচীন মিশরীয় লিপিতে অত্যধিক মূত্র নির্গমন বলে এর উল্লেখ পাওয়া যায়। প্রথম বর্ণিত রোগটিকে টাইপ-১ ডায়াবেটিস বলে মনে করা হয়। প্রায় সেই সময়ে আমাদের প্রাচীন ভারতীয় আয়ুর্বেদ চিকিৎসকগণ ডায়াবেটিস অস্তিত্ব খুঁজে পান এবং এই রোগীর মূত্র পিপড়াদের আকৃষ্ট করত দেখে তাঁরা এই রোগের নাম দিয়েছিলেন মধুমেহ। মধুমেহ সংস্কৃত শব্দ। সংস্কৃত ভাষায় মধু মানে শর্করা আর মেহ মানে মূত্র বুঝায়। গ্রিক চিকিৎসক অ্যাপোলোনিয়াস অব মেমফিস খ্রিস্টপূর্ব ২৩০ সালে প্রথমবারের মতো ডায়াবেটিস শব্দটি ব্যবহার করেন। রোমান সাম্রাজ্যের সময় রোগটি বিরল ছিল। সেই সময় বিখ্যাত গ্রিক চিকিৎসক গেইলেন মন্তব্য করেন যে তিনি তাঁর পেশাগত জীবনে মাত্র দুজন ডায়াবেটিস রোগী দেখেছেন।৪০০-৫০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে টাইপ-১ ও টাইপ-২ ডায়াবেটিসকে দুটি আলাদা রোগ হিসেবে সর্বপ্রথম শনাক্ত করেছিলেন দুই প্রাচীন ভারতীয় আয়ুর্বেদ চিকিৎসক সুশ্রুত ও চরক যথাক্রমে তাঁদের সুশ্রুত সংহিতা ও চরক সংহিতা নামক পুস্তকে। সেখানে তাঁরা বলেছিলেন টাইপ-১ তারুণ্য ও টাইপ-২ অধিক ওজনের সাথে সম্পর্কিত। ডায়াবেটিস ইনসিপিডাস নামে আরেকটি রোগ রয়েছে যেটিও বহুমূত্রের সাথে সম্পর্কিত তাই এই রোগ থেকে পৃথকীকরণের জন্য ডায়াবেটিসের সাথে মেলিটাস (mellitus) শব্দ যোগ করেন ব্রাইটন জন রোল নামে একজন বিজ্ঞানী। বিংশ শতাব্দীর প্রথমাংশের আগ পর্যন্ত এই রোগের ফলপ্রসু কোনো চিকিৎসা ছিল না। দুই কানাডীয় বিজ্ঞানী ফ্রেডরিক বেনটিং ও চার্লস বেস্ট ১৯২১ ও ১৯২২ সালে ইনসুলিন আবিষ্কার করেন।এরপর ১৯৪০ সালের দিকে দীর্ঘক্ষণ সক্রিয় নিউট্রাল প্রোটামিন হ্যাগেডর্ন (NPH) ইনসুলিন উদ্ভাবিত হয়।

ডায়াবেটিস কিভাবে হয় 

ডায়াবেটিস কি? ২০১৫ সাল পর্যন্ত সারা বিশ্বে প্রায় ৩৯ কোটি ২০ লাখ ব্যক্তি টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত যা সর্বমোট ডায়াবেটিস রোগীর ৯০ শতাংশ। এই সংখ্যা বিশ্বের মোট জনগোষ্ঠীর ৬ শতাংশের সমান। উন্নত ও উন্নয়নশীল বিশ্ব উভয় জায়গাতেই ডায়াবেটিস রোগের প্রাদুর্ভাব প্রায় সমান।  তবে অনুন্নত বিশ্বে এই রোগীর সংখ্যা কম।নারীজাতি ও কিছু নৃগোষ্ঠী, যেমন দক্ষিণ এশীয়, প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপবাসী, ল্যাটিনো ও আমেরিকার আদিবাসী গোষ্ঠী অধিকতর ঝুঁকিতে রয়েছে।  কিছু নৃগোষ্ঠীর পশ্চিমা জীবনরীতিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ার কারণে এমনটা হতে পারে। ঐতিহ্যগতভাবে টাইপ-২ ডায়াবেটিসকে প্রাপ্তবয়স্কদের রোগ বলে মনে করা হলেও বর্তমান সময়ে শিশুদের মাঝেও স্থূলতা ও টাইপ-২ ডায়াবেটিসের হার সমান্তরালভাবে বেড়ে চলেছে। মার্কিনযুক্তরাষ্ট্রের তরুণদের মধ্যে টাইপ-১ এর মতো টাইপ-২ ডায়াবেটিসও সমানভাবে পাওয়া যাচ্ছে। ১৯৮৫ সালে সারা বিশ্বে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৩ কোটি যা বৃদ্ধি পেয়ে ১৯৯৫ সালে ১৩ কোটি ৫০ লাখ ও ২০০৫ সালে ২১ কোটি ৭০ লাখ হয়। সারা বিশ্বে প্রবীণ ব্যক্তির সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া, শারীরিক পরিশ্রমের অভাব ও স্থূলতার হার বৃদ্ধি পাওয়া এর অন্যতম প্রধান কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। ২০০০ সাল পর্যন্ত যে পাঁচটা দেশ ডায়াবেটিস রোগীর জন্য শীর্ষস্থানে ছিল তা হল ভারত ( ৩ কোটি ১৭ লাখ), চীন ( ২ কোটি ৮ লাখ), যুক্তরাষ্ট্র ( ১ কোটি ৭৭ লাখ), ইন্দোনেশিয়া ( ৮৪ লাখ) ও জাপান (৬৮ লাখ)। [৯৭]বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ইতোমধ্যে ডায়াবেটিসকে বৈশ্বিক মহামারী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।

ডায়াবেটিস কত হলে নরমাল

জাতিসংঘের ঘোষণা 

২০০৬ খ্রিষ্টাব্দের ২০ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ এর ৬১/২২৫ নম্বর ঘোষণায় ডায়াবেটিসকে দীর্ঘমেয়াদি, অবক্ষয়ী ও ব্যয়বহুল ব্যাধি হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে যা মানবদেহে মারাত্মক জটিলতার সৃষ্টি করতে পারে।

ডায়াবেটিস দিবস বা বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস

বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস হল বিশ্বজুড়ে ডায়াবেটিস সম্পর্কে বিশ্বময় সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে একটি ক্যাম্পেইন, যা প্রতিবছর ১৪ই নভেম্বর অনুষ্ঠিত হয়। বিশ্বজুড়ে ডায়াবেটিস রোগ ব্যাপক হারে বেড়ে যাওয়ায়,বিশ্ব ডায়াবেটিস ফেডারেশন (আইডিএফ) ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১৯৯১ সাল-এ ১৪ নভেম্বরকে ডায়াবেটিস দিবস হিসেবে ঘোষণা করে

আরও পড়ুনঃ ডায়াবেটিসের লক্ষণ কি কি?

ডায়াবেটিস নিয়ে কি আপনি সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হতে পারেন?

শুধু ঔষধ ও চিকিৎসা ডায়াবেটিস নিরাময় করতে পারে না। মানুষ ডায়াবেটিস নিয়ে ও সুস্বাস্থ্যে থাকতে পারে যদি তাদের রোগটি সম্পর্কে ভাল জ্ঞান থাকে ও রোগটি নিয়ন্ত্রণের ব্যপারে তারা খুব যত্নবান হয়। সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো –

১। স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণ করা

২।  নিয়মিত ব্যায়াম করা

৩। মাঢ়ীর ও দাঁত পরিষ্কার রাখা

৪। পায়ের যত্ন নেয়া

৫। দুঃশ্চিন্তা না করা

৬। বেশী করে বিশ্রাম নেয়া। 

এগুলোর সাথে প্রয়োজনে ঔষধও সেবন করতে হবে।

বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি

বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির তথ্য অনুসারে, সারা দেশে সমিতির আওতাভুক্ত ১১৩টি শাখায় ২০২০–২১ অর্থবছরে অর্থাৎ করোনাকালে সাড়ে তিন লাখ নতুন ডায়াবেটিস রোগী নিবন্ধিত হয়েছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে সমিতিতে এ নিয়ে নিবন্ধিত রোগীর সংখ্যা ৫৬ লাখ ২৬ হাজার। ২০১৯–২০ অর্থবছরে নতুন রোগী ছিল ৩ লাখের কিছু বেশি। ২০১৭–১৮ এবং ২০১৮–১৯ অর্থবছরে নতুন রোগী যথাক্রমে ৫ লাখ ও ৪ লাখ ৮৫ হাজার বেড়েছিল। গত সাত বছরে দেশে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে, ৩০ লাখ থেকে ৫৬ লাখে দাঁড়িয়েছে।

আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশনের তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে ৮৪ লাখ ডায়াবেটিস রোগী আছেন। তবে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি এক জরিপের ভিত্তিতে মনে করে, এ সংখ্যা অনেক বেশি। অনেকে জানেনই না তাঁদের ডায়াবেটিস আছে। ২০১৮ সালে সমিতি সারা দেশে ২৫ বছরের বেশি বয়সী এক লাখ নারী–পুরুষের ওপর জরিপ চালিয়ে এক–চতুর্থাংশ ব্যক্তির ডায়াবেটিস শনাক্ত করে।

আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশন (আইডিএফ) ডায়াবেটিসকে বৈশ্বিক মহামারি হিসেবে ঘোষণা করেছে। কারণ, বিশ্বে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা, এ–সংক্রান্ত স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি জটিলতা এবং মৃত্যু বেড়ে যাচ্ছে। শুধু উন্নত কিছু দেশ বৃদ্ধির হারে লাগাম টানতে পেরেছে।

আফ্রিকার দেশগুলোর পর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে সবচেয়ে বেশি ডায়াবেটিস রোগী বাড়ছে। বাংলাদেশের চিত্র মোটেই সুখকর নয়। আইডিএফের ২০২১ সালের সমীক্ষা অনুযায়ী, পাকিস্তানের পর বাংলাদেশে এ রোগী বাড়ার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি।

ওজনের সঙ্গে ডায়াবেটিসের সম্পর্ক কী?

ডায়াবেটিস কি? ওজনের সঙ্গে ডায়াবেটিসের সম্পর্ক নিয়ে আমাদের নানা ধরনের ধারনা রয়েছে।এতে সরাসরি বৈজ্ঞানিক সম্পর্ক আছে, এমনটা বলা যাবে না। তবে যাঁদের ডায়াবেটিস আছে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, তাঁরা ফাস্ট ফুড জাতীয় খেতে ভালোবাসেন। শুয়ে-বসে সময় কাটান, ওজন বেশি। এ সব কারণে তাঁদের শরীরে ইনসুলিন প্রতিরোধক বেড়ে যায়। ফলে ইনসুলিন নিঃসরণ হলেও সেটা কাজ করতে পারে না। তাই এ সময় টাইপ-২ ডায়াবেটিস হওয়ার আশঙ্কা প্রবল থাকবে। বডি-মাস-ইনডেক্স ( BMI) ঠিক রাখা খুবই জরুরি।ডায়াবেটিস কি বংশগত রোগ? পারিবারিক ইতিহাস থাকলেও জিনগত ভূমিকা বা জেনেটিক রোলের ক্ষেত্রে ডায়াবেটিস হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। একটি হলো জিনগত ভূমিকা, আরেকটি হলো জীবনযাপন বা লাইফস্টাইল। পরিবারে বাবা-মায়ের ডায়াবেটিস আছে মানে, আপনার ডায়াবেটিস হওয়ার আশঙ্কা ৫০ শতাংশ বেশি। আর আপনার জীবনযাপন যদি স্বাস্থ্যকর না হয়, সে ক্ষেত্রে আরও ৫০ শতাংশ। মানে শতভাগ। ঘরের কাজ, অফিসের কাজ, যা-ই থাকুক না কেন, ব্যায়ামের বিকল্প নেই। প্রতি সেকেন্ডে দুই পা হাঁটতে হবে। জোরে জোরে প্রতিদিন অন্তত আধা ঘণ্টা হাঁটতে হবে।

Leave a Comment